তবে শুধু ভক্তকূল নয়, উৎসবের আয়োজক, প্রতিমা শিল্পী এবং দর্শকসহ নানা পেশার মানুষের মধ্যে এক ধরণের মনোকষ্ট ছড়িয়েছে।
গত বছর শিকদার বাড়ি পূজামন্ডপে ৮০১টি প্রতিমা সাজিয়ে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে আয়োজক কর্তৃপক্ষ এবছর উৎসব না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই মন্ডপে দেব-দেবীর কোনো প্রতিমা সাজানো হবে না। তবে ধর্মীয় রীতি রক্ষার্থে ঘটে পূজার আয়োজন করা হবে।
জানা গেছে, বাগেরহাট সদর উপজেলার হাকিমপুর গ্রামে শিকদার বাড়ির পারিবারিক পূজা মন্ডপে ২০১১ সালে বিভিন্ন দেব-দেবীর ২৫১টি প্রতিমা সাজিয়ে দুর্গোৎসব শুরু করা হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর সেখানে দেব-দেবীর প্রতিমার সংখ্যা বেড়ে চলছিল। গত বছর ২০১৯ সালে শিকদার বাড়ি পূজামন্ডপে ৮০১টি দেব-দেবীর প্রতিমা সাজিয়ে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়।
দুর্গোৎসব আরও প্রাণবন্ত এবং সব ধর্মের মানুষের মধ্যে উৎসব ছড়িয়ে দিতে প্রতিবছর আয়োজনে ভিন্নতা আনা হয়।
দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে প্রতিমার মাধ্যমে বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলা হয়। ওই পূজামন্ডপ এমনভাবে সাজানো হয় দেখলে মনে হতো দেব-দেবীরা যেন স্বর্গ থেকে মর্তলোকে নেমে এসেছেন। কারিগড়দের নিপূন হাতের ছোয়া আর রং তুলিতে মাটির প্রতিমা এমনভাবে সাজানো হতো দেখলে মনে হতো যেন দেব-দেবীর প্রতিচ্ছবি।
পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘীরে জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ দর্শনার্থী আর ভক্তকূলের ঢল নামতো পূজামন্ডপে। ওই পূজামন্ডপ এবং আশপাশের এলাকায় রিতিমতো জনসমুদ্রে পরিণত হতো। এবছর শিকদার বাড়িতে দুর্গোৎসব হচ্ছেনা এমন খবরে ভক্তরা চোখে জল ধরে রাখতে পারেনি।
প্রতিবছর দুর্গোৎসব শেষ হওয়ার কিছুদিন পর আগামী বছরে উৎসব নুতন মাত্রায় নিতে আয়োজকদের প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রায় সারা বছর ধরে চলে নানা প্রস্তুতি। প্রতিমা শিল্পীরা ৬-৭ মাস আগে থেকে খড়-কুটা আর মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করতেন। দেশি-বিদেশি নানা রং আর নানা ধরণের অলংকার দিয়ে প্রতিমা সাজানো হতো। দুর্গোৎসবের তিন মাস আগে থেকে সাজসজ্জ্বা আর আলোক সজ্জ্বার কাজে ব্যস্ত সময় কেটেছে কর্মীদের। মহামায়া দেবী দুর্গার সঙ্গী হিসেবে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগের বিভিন্ন দেব-দেবী প্রতিমা সাজানো হতো এই পূজামন্ডপে। এখন সেখানে কোনো আয়োজন নেই।
শিকদার বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল সেই পূজা প্যান্ডেলে প্রবেশের দুটি পথই তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। সেখানে প্রতিমা তৈরি করা হচ্ছেনা। বিগত বছরগুলোতে দুর্গাপূজার কয়েক মাস আগে থেকে সেখানে নানা প্রস্ততি দেখা গেছে। কিন্তু এবছর করোনাভাইরাসের কারণে সব আয়োজন বন্ধ রয়েছে। আগামী ২১ অক্টোবর দেবীর বোধনের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে দুর্গাপূজা।
সনাতন ধর্ম সম্পর্কে সমাজকে জাগ্রত করা এবং গোটা বিশ্বকে সনাতন ধর্মের দেব-দেবীর পূজার মহত্ব জানানোর জন্য ডাক্তার দুলাল কৃষ্ণ শিকদার ২০১১ সাল থেকে নিজ বাড়িতে বিশাল পরিসরে এই শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু করেন।
শিকাদার বাড়ি দুর্গোৎসবের আয়োজক শিল্পপতি লিটন শিকদার জানান, ‘করোনা মহামারির কারণে এবছর আমরা উৎসব থেকে পিছিয়ে এসেছি। একারণে দেব-দেবীর কোনো প্রতিমা তৈরি করা হচ্ছে না। সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে এখানে এই মহাউৎসব পালন করা সম্ভব হবে না। প্রতিমা তৈরি করলে দেশি-বিদেশি লাখ লাখ দর্শনার্থী উৎসব দেখতে আসবে। বিধায় ঘটে পূজা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
শিকদার বাড়ি পূজামন্ডপে গত বছর ৮০১টি প্রতিমা তৈরির কারিগড় (প্রতিমা শিল্পি) বিজয় কৃষ্ণ বাছাড় বলেন, ‘প্রতিমা তৈরি করে যে অর্থ পাই, তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। প্রতিমা তৈরি ছাড়া বিকল্প কোনো কাজ তাদের নেই। গত বছর প্রায় ছয় মাস ধরে তারা ১৫ জনে মিলে ৮০১টি দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরি করে। সেখান থেকে গেলো বছর তাদেরকে চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দেওয়া হয়। এক পূজামন্ডপে প্রতিমা তৈরি করে যে টাকা তারা পেয়ে ছিল তাতেই খুঁশি।’
এছরও শিকদার বাড়িতে তাদের প্রতিমা তৈরির কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে প্রতিমা তৈরি হচ্ছেনা। কিভাবে সংসার চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় এই প্রতিমা শিল্পী।
বাগেরহাট জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অমিত রায় জানান, বাগেরহাটের শিকাদার বাড়িতে সবচেয়ে বড় দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়ে থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে শিকদার বাড়ির উৎসব হবে না। এছাড়া জেলার কোথাও এবছর দুর্গোৎসব হবে না। কোনো রকমে পূজা হবে।
স্মৃতিকনা বিশ্বাস, কমলা দাস, স্বপন চক্রবর্ত্তী, নির্মল মজুমদার, দেবাশিষ পাল, তরুন সরকারসহ বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীর সাথে কথা হলে তারা জানান, কয়েক বছর ধরে ছেলে-মেয়ে, আত্নীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব মিলে তারা শিকদার বাড়িতে দুর্গোৎসব দেখতে যেতেন। সেখানে গিয়ে দেব-দেবীর প্রতিমা দেখে তাদের মনে হতো তারা যেন স্বর্গপুরিতে এসেছে। এক পূজা প্যান্ডেলে এত সংখ্যক প্রতিমা দেখে তারা অভিভূত হতেন।
এবছর শিকদার বাড়িতে তাদের যাওয়ার প্রস্ততি থাকলেও দুর্গোৎসব হবে না এমন খবর তাদেরকে ব্যথিত করেছে।